জিএসটি পরিষদের প্রথম দিনের বৈঠক শেষে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি জানালেন, করের চারটি হার (৫, ১২, ১৮ ও ২৮ শতাংশ) ঠিক হয়েছে সর্বসম্মতিতে। জিএসটি চালু করার ফলে রাজ্যগুলির রাজস্বের ক্ষতি পূরণের জন্য কিছু পণ্যের উপর আপাতত সেসও বসানো হবে। তাঁর এবং মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যনের দাবি, এতে মূল্যবৃদ্ধির হার বেলাগাম হওয়ার আশঙ্কা কম। বরং জিনিসপত্রের দাম কিছুটা কমারই সম্ভাবনা।
এমনিতে যথাসময়ে জিএসটি চালুর এই চেষ্টাকে স্বাগত জানালেও, শিল্পের আর্জি, দীর্ঘ মেয়াদে এতগুলি হার না-রেখে, তা একটি-দু’টিতে নামিয়ে আনুক কেন্দ্র। শেষ পর্যন্ত কোন পণ্য কোন করের আওতায় পড়বে আর এখন বসানো সেস পরে ছেঁটে ফেলা যাবে কি না, তার উপর জিএসটি-র সাফল্য নির্ভর করবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরাও।
গত মাসেও পরিষদের সুপারিশ ছিল, জিএসটি-র চারটি হার ৬, ১২, ১৮ ও ২৬ শতাংশ করার। কিন্তু রাজ্যগুলির অর্থমন্ত্রীদের সঙ্গে কথাবার্তার পরে এ দিন জেটলি জানান, বেশ কিছু অত্যাবশ্যক পণ্যে (মূলত খাদ্য) কর থাকছে না। অর্থাৎ সেখানে করের হার শূন্য শতাংশ। আমজনতা রোজকার জীবনে খুব বেশি ব্যবহার করে, এমন নানা পণ্যে কর বসবে ৫%। প্রাথমিক ভাবে কথা ছিল, মূল হার হবে একটিই, ১৮%। কিন্তু তার বদলে মূল হার ঠিক হয়েছে দু’টি— ১২% ও ১৮%। অধিকাংশ পণ্য এই মূল হারের আওতায় পড়বে। তাই, ১৮-র পাশাপাশি সেখানে ১২ শতাংশের দরজাও খোলা থাকায় জিনিসপত্রের দাম মাথা তোলার সম্ভাবনা কমবে বলে অর্থমন্ত্রীর দাবি। তিনি বলেন, তেল, সাবান, টুথপেস্টের মতো নিত্য ব্যবহারের সামগ্রীতেও এখন বেশি কর দিতে হয়। তা নামানো হবে ১৮ শতাংশে।
ফ্রিজ-টিভি-মাইক্রোওয়েভ আভেনের মতো বৈদ্যুতিন পণ্যে এখন উৎপাদন শুল্ক লাগে ১২.৫%। সঙ্গে যুক্তমূল্য কর (ভ্যাট) ১৪.৫%। মোট ২৭%। অন্যান্য সব কিছু মিলিয়ে তা ৩০-৩১ শতাংশে পৌঁছয়। জিএসটি জমানায় এই সমস্ত পণ্য পড়বে ২৮ শতাংশের বন্ধনীতে।
২৮ শতাংশের থেকেও বেশি ‘কর’ দিতে হবে দামি গাড়ির মতো বিলাসসামগ্রী ও সিগারেট-তামাক-পানমশলা-কোল্ড ড্রিঙ্কের মতো ক্ষতিকর পণ্যে। কারণ, সেখানে ২৮% করের উপরে আবার গুনতে হবে বাড়তি সেস। এখন ওই সমস্ত সামগ্রীতে যে হারে কর দিতে হয়, জিএসটি জমানায় তা অন্তত কমবে না বলে জানিয়েছেন জেটলি।
• চার হারে জিএসটি— ৫, ১২, ১৮, ২৮% |
• খাদ্য-সহ কিছু পণ্যে কর বসছে না |
• বেশি ব্যবহার হয় এমন পণ্যে কর ৫% |
• ফ্রিজ, টিভি-র মতো পণ্যে কর ২৮% |
• দামি গাড়ির মতো বিলাসসামগ্রী এবং সিগারেটের মতো ক্ষতিকর পণ্যে ২৮%-র উপরে বাড়তি সেস |
জিএসটি চালুর পরে প্রথম পাঁচ বছর রাজস্ব কমলে, রাজ্যগুলিকে তা পুষিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কেন্দ্র। এই ক্ষতিপূরণ গুনতে প্রথম বছর লাগবে ৫০ হাজার কোটি। সেই টাকা জোগাড় করতেই এই সেস বসানোর সিদ্ধান্ত বলে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর দাবি। প্রতি বছর এই সেসের হার পুর্নবিবেচনা করা হবে। পাঁচ বছর পরে খতিয়ে দেখা হবে যে, তা আর জারি রাখা হবে কি না।
জিএসটি-র চূড়ান্ত হার প্রসঙ্গে এ দিন জেটলি বলেন, প্রাথমিক প্রস্তাব ছিল রোজকার জীবনে বহুল ব্যবহৃত পণ্যে করের হার ৬% রাখা। কিন্তু সাধারণ মানুষের কথা ভেবে তা করা হয়েছে ৫%। তেমনই বিলাসসামগ্রী ও ক্ষতিকর পণ্যে বসা করের হার হওয়ার কথা ছিল ২৬%। তা হয়েছে ২৮%। তাঁর মতে, যাঁরা দামি, বিলাসবহুল গাড়ি চড়বেন, দু’পয়সা বাড়তি কর গুনতেও তাঁরা পিছপা হবেন না।
তবে এ দিনের বৈঠকেই যে সমস্ত বিষয় খোলসা হয়ে গিয়েছে, এমন নয়। যেমন, এখনও ঠিক হয়নি পরিষেবা করের হার। অর্থমন্ত্রীর আশা, তা একটিই হবে। রাজস্ব সচিব হাসমুখ অধিয়ার ইঙ্গিত, তা হতে পারে ১৮%। প্রাথমিক প্রস্তাবে সোনাকে বিশেষ পণ্য হিসেবে গণ্য করে তার উপর ৪% কর চাপানোর কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু এ দিন সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। জেটলি জানান, কোন পণ্যের উপর ঠিক কোন হারে কর বসবে, এ বার তা ঠিক করবেন সচিবরা। তার পর রাজস্ব আদায় কেমন হচ্ছে, তা আঁচ করে, সেই অনুযায়ী সোনার উপর করের হার ঠিক করা হবে।
কেন্দ্রের দাবি, এখনও পর্যন্ত যে ভাবে এগোনো গিয়েছে, তাতে আগে বেঁধে দেওয়া সময়ে (২০১৭ সালের ১ এপ্রিল) জিএসটি চালু করা সম্ভব। পা ফেলতে কোন পণ্যে কত কর বসবে, তা দ্রুত ঠিক করে ফেলতে চায় কেন্দ্র। তারপরে তা ফের যাবে পরিষদে।
জিএসটি তিন রকম:— (১) কেন্দ্রের বসানো (সিজিএসটি) (২) রাজ্যের বসানো (এসজিএসটি) (৩) ইন্টিগ্রেটেড বা সম্মিলিত (আইজিএসটি), যা সংগ্রহ করবে কেন্দ্র। পণ্য তৈরি ও কেনা-বেচা একটি রাজ্যের মধ্যেই হলে, বসবে সিজিএসটি ও এসজিএসটি। কিন্তু একাধিক রাজ্যে তা হলে, বসবে আইজিএসটি। কেন্দ্রের দাবি, এ দিন করের হার ঠিক হওয়ায় সিজিএসটি এবং আইজিএসটি সংক্রান্ত বিল এ মাসে সংসদে পেশ করার পথে আরও এক ধাপ এগোনো গেল। কেন্দ্র ও রাজ্য উভয়ের কর আদায়ের অধিকার (ডুয়াল কন্ট্রোল) নিয়েও আলোচনা হওয়ার কথা শুক্রবারের বৈঠকে।
দ্রুত জিএসটি চালুর জন্য কেন্দ্রের উদ্যোগের প্রশংসা করলেও, শিল্পমহল চায় দীর্ঘ মেয়াদে দু’টির বেশি হার না থাকুক। কিছু দিন আগে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমও কলকাতায় এসে বলেন, জিএসটি-র হার তিনটির বেশি হলে, হারিয়ে যাবে তা চালুর মূল উদ্দেশ্য। আদপে সেটি হবে ভ্যাট-এর পুরনো মদকেই নতুন বোতলে পোরার সামিল। জেটলির অবশ্য দাবি, এই চার হারকে সমর্থন জানিয়েছেন সব কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রীই।
জিএসটি উদ্দেশ্য কর ব্যবস্থা সরল করা। সেখানে জিএসটি-র জন্য প্রতি রাজ্যে আলাদা নথিভুক্তি, নিয়ম মানা ও হিসেবের বাধ্যবাধকতা থাকলে, শিল্পের সমস্যা হবে বলে সিআইআই-এর আশঙ্কা।